চাকরি পেলেন পাচারের শিকার সেই ৫৯ নারী-পুরুষ

(Last Updated On: )

যশোরে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ব্যতিক্রমী এক চাকরি মেলা। যেখানে বিদেশে গিয়ে প্রতারিত হওয়া ৮৫ জন নারী-পুরুষ এসেছিলেন চাকরিপ্রত্যাশী হয়ে। এর মধ্যে ৫৯ জনেরই চাকরি হয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে।

সুইজারল্যান্ডের আর্থিক সহায়তায় উইনরক ইন্টারন্যাশনাল বুধবার যশোরের শেখ হাসিনা সফটওয়্যার পার্কে এই চাকরি মেলার আয়োজন করে। মেলায় ১০টি প্রতিষ্ঠান চাকরির অফার নিয়ে স্টল দিয়েছিল। যশোরের জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান প্রধান অতিথি হিসেবে মেলার উদ্বোধন করেন।

মেলায় খুলনা থেকে আসা একজন নারীর চাকরি হয়েছে আকিজ গ্রুপে এসিস্ট্যান্ট অপারেটর পদে। মাসিক বেতন সাড়ে সাত হাজার টাকা। সাপ্তাহিক ইনসেনটিভের পাশাপাশি থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে অফার লেটারে।

জর্ডানে গিয়ে প্রতারণার শিকার ওই নারী বলেন, আমার খুব ভালো লাগছে। বিদেশ থেকে প্রতারিত হয়ে ফিরে আসার পর মন ভেঙে যায়। আমি ভাবতাম বেঁচে থাকার আর কোনো মানে নেই, আমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। তখনই আশ্বাসের পক্ষ থেকে (উইনরক ইন্টারন্যাশনালের প্রকল্পের নাম) আমার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তাদের মাধ্যমে আমি তিন মাসের দর্জি প্রশিক্ষণ কোর্সে অংশ নেই, আজই যার শেষ দিন। এরই মধ্যে আমার চাকরির নিশ্চয়তা পাওয়ায় মনে হচ্ছে জীবন এখনো থেমে যায়নি।

তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে যে বেতন পাব সেটা দিয়েই আমি সামনে এগিয়ে যাব ইনশাল্লাহ। তাছাড়া চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠান বলেছে আমার কাজের ওপর ভিত্তি করে বেতন-ভাতাও বৃদ্ধি পাবে।

মেলায় এসে চাকরি পেয়ে খুবই খুশি অপর এক নারী। সুখের আশায় সৌদি আরবে যেয়ে প্রতারিত হয়ে ফিরে আসা খুলনার এই নারী যশোরের মেলায় এসে চাকরির নিশ্চয়তা পেয়েছেন। দেশের স্বনামধন্য আকিজ গ্রুপ সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকারে তাকে নিজেদের প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সুযোগ দিয়েছে।

এতেই আপ্লুত তাসলিমা নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে যেয়ে বলেন, আমি খুবই খুশি যে আমি আকিজ গ্রুপে চাকরি পেয়েছি। তারা আমার যাতায়াতের জন্য গাড়ি এবং থাকার ব্যবস্থাও করার কথা বলেছে। তবে আমি নিজের বাড়িতে থেকেই প্রতিদিন যাতায়াত করব।

মেলার উদ্বোধনী বক্তৃতায় যশোরের জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান চাকরি মেলার ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, পাচারের শিকার অনেক মানুষকে আমরা বিদেশ থেকে ফিরিয়ে আনছি। তাদের জন্য নানা কার্যক্রমও পরিচালিত হচ্ছে। শুধু একটা গ্যাপ ছিল, তা হলো তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। আশ্বাস প্রকল্প সেই গ্যাপটি পূরণ করছে।

তিনি আয়োজক উইনরক ইন্টারন্যাশনাল ও তার পার্টনার সংস্থাসমূহের পাশাপাশি চাকরি মেলায় চাকরি দিতে আসা প্রতিষ্ঠানগুলোকেও ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিদেশ থেকে ফিরিয়ে আনার পর আর কোনো ফলোআপ রাখা হয় না। সমাজে পুনঃপ্রতিষ্ঠাসহ তাদের জীবনমান উন্নয়নে যদি একটি শক্ত আর্থিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো না যায় তাহলে পুনরায় পাচারের ঝুঁকি থাকে। ভাগ্যাহত এসব মানুষকে যদি সত্যিকার অর্থে একটা চাকরির ব্যবস্থা করা যায় সেটাই হবে সবচেয়ে বড় কাজ।

উইনরক ইন্টারন্যাশনালের টিম লিডার দিপ্তা রক্ষিত বলেন, যশোর, খুলনা এবং সাতক্ষীরায় প্রকল্পটি ছয়টি সংস্থার মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। এগুলো হলো রাইটস যশোর, ঢাকা আহছানিয়া মিশন, অগ্রগতি এবং সিডাব্লিউসিএস। টেকনিক্যাল সাপোর্ট দিচ্ছে যশোরের রুরাল রিকনস্ট্রাকশন ফাউন্ডেশন এবং খুলনার এমএডাব্লিউটিএস। প্রকল্পের কর্মীরা এসব এলাকায় ঘুরে ঘুরে পাচারের সার্ভাইভারদের খুঁজে বের করে আনছেন। পরবর্তীতে তাদেরকে অন্যান্য সেবার পাশাপাশি বিভিন্ন ট্রেডে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। যেসব ট্রেডে সার্ভাইভাররা প্রশিক্ষিত হচ্ছেন সেগুলোর মধ্যে রয়েছে সেলাইমেশিন, ইলেক্ট্রিক্যাল হাউজওয়ারিং, রেফ্রিজারেশন ও এয়ারকন্ডিশনার, মোটরসাইকেল ম্যাকানিক্স, ড্রাইভিং ও বিউটিফিকেশন।

মেলায় আরও সেসব প্রতিষ্ঠান চাকরির পসরা সাজিয়ে বসেছে সেগুলো হলো প্রাণ-আরএফএল, স্টান্ডার্ড গ্রুপ, ভেনাস অটো, আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশন, ফ্রন্টডেস্ক বাংলাদেশ, সম্রাট ইলেকট্রনিক, জিকিউ বলপেন ইন্ডাস্ট্রি, শিমুল ইলেকট্রনিক্স এবং বিএপি।

মেলা ঘুরে দেখা যায়, সার্ভাইভাররা ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন। অনেককে তাৎক্ষণিকভাবে অফার লেটার দেয়া হচ্ছে, অনেককে বলা হচ্ছে পরবর্তীতে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হবে। অফার লেটার পাওয়ার পর সেই চাকরি পছন্দ না হওয়ায় রয়েছে ভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরির সুযোগও।

উইনরক ইন্টারন্যাশনালের আশ্বাস প্রকল্পের টিম লিডার দিপ্তা রক্ষিত বলেন, মানব পাচারের শিকার নারী ও পুরুষের জন্য কাজ করছে আশ্বাস প্রকল্প। যারা সুখের আশায় দালালের খপ্পরে পড়ে বা অন্যভাবে বিদেশে যেয়ে প্রতারিত হন সেই সমস্ত মানুষ দেশে ফিরে ভেঙে পড়েন। সহায় সম্বল হারিয়ে তারা এক প্রকার নিঃস্ব হয়ে যান। এসব মানুষকে যদি অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করা না যায় তাহলে তারা আবার পাচারের শিকার হতে পারেন। সে কারণেই আশ্বাস প্রকল্পের কর্মীরা তাদের খুঁজে বের করে নানা আয়বর্ধক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। পরে তারা যাতে প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান কাজে লাগিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারেন, অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারেন তারও ব্যবস্থা করা হয়। যশোরের চাকরিমেলায় প্রশিক্ষিত এসব নারী ও পুরুষ সার্ভাইভারদের জন্যই আয়োজন করা হয়েছে, যেখানে যশোর এবং ঢাকার নামকরা প্রতিষ্ঠানগুলোও অংশ নিয়েছে।

রাইটস যশোরের নির্বাহী পরিচালক বিনয় কৃষ্ণ মল্লিক বলেন, যশোর, খুলনা এবং সাতক্ষীরা জেলায় পাচারের শিকার হয়ে বিদেশ থেকে ফিরে আসা প্রায় আড়াই হাজার সার্ভাইভারকে নানা ট্রেডে প্রশিক্ষিত করা হয়েছে। অন্যদের জবপ্লেসমেন্টের জন্য এ ধরনের মেলা বা উদ্যোগ অব্যাহত থাকবে।

রুরাল রিকনস্ট্রাকশন ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ফিলিপ বিশ্বাস উইনরোক ইন্টারন্যাশনালকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, অসহায় মানুষের সেবায় তাদের দোরগোড়ায় যেভাবে সংস্থাটি এগিয়ে এসেছে তা বিরল। এ ধারা অব্যাহত রাখতে পারলে মানবপাচার অনেকাংশে কমে আসবে।

মেলার প্রথম ঘণ্টায় কয়েকজন সার্ভাইভারকে নিজেদের প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দিয়েছে আকিজ গ্রুপ। এ প্রতিষ্ঠানের এইচআর সুব্রত শর্মা বলেছেন, চাকরির কথা বলে বিদেশে নিয়ে প্রতারণা করার মধ্যে কোনো বাহাদুরি নেই। বরং ভাগ্যাহত একজন মানুষকেও যদি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যায় সেটাই হবে সত্যিকারের কাজ। চাকরি মেলায় আমাদের প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে অংশ নেওয়ার সুযোগ পাওয়ায় আমরা খুবই গর্বিত। আকিজ গ্রুপের পক্ষ থেকে চেষ্টা থাকবে যত বেশিসংখ্যক নিয়োগ দেওয়া যায়।

এ প্রকল্পের ঢাকা আহছানিয়া মিশনের প্রকল্প পরিচালক রফিকুল ইসলাম জানান, মেলায় ৮৫ জন চাকরিপ্রত্যাশী ছিলেন। এদের মধ্যে ৫৯ জনের চাকরি হয়েছে। সবচেয়ে বেশি চাকরি হয়েছে প্রাণ গ্রুপ ও আকিজ গ্রুপে।

মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন- সমাজসেবা অধিদপ্তর যশোরের উপ-পরিচালক অসিত কুমার সাহা, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আনিসুর রহমান, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক শহিদুল ইসলাম এবং টিটিসির অধ্যক্ষ ইঞ্জিনিয়ার সাজ্জাদ হোসেন ভূঁইয়া।

Facebook Comments Box