স্বপ্ন ছিল ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হবে, হয়ে গেল খুনি

(Last Updated On: )

মেধাবী ছাত্র ছিল শামীম বিল্লাহ্। এলাকায় লেখাপড়ায় ছিল বেশ সুনাম। অষ্টম শ্রেণিতে পেয়েছিল বৃত্তি। এসএসসি-এইচএসসিতে গোল্ডেন এ প্লাস। গরিব বাবার স্বপ্ন ছিল ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হবে। বাবার সেই স্বপ্ন এখন কারাগারে বন্দি, খুনি হয়ে ছেলে এখন ফাঁসির আসামি। বাবা বলছেন, কতবার বলেছি রাজনীতি করিসনে। রাজনীতি ধ্বংস করে দিল আমাদের পরিবারটি। সারা জীবনের স্বপ্ন শেষ হয়ে গেল।

শামীম বিল্লাহ্ সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার ভুরুলিয়া ইউনিয়নের খানপুর গ্রামের ট্রাকচালক আমিনুর রহমান। আববার হত্যা মামলায় ২০ ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামির মধ্যে একজন শামীম বিল্লাহ্। আবরার হত্যা মামলায় এজাহারভুক্ত ১৪ নম্বর আসামি সে।

শামীম বিল্লাহ্’র বাবা আমিনুর রহমান ট্রাকচালক। লিটল টাটা গ্রুপের কমিশন ভিত্তিতে চার বছর ধরে ট্রাক চালান তিনি। কষ্টে অর্জিত টাকায় ছেলেকে পড়াচ্ছিলেন বুয়েটে। চেয়েছিলেন ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ার বানাবেন। সবার মুখ উজ্জল হবে। স্বচ্ছলতা ফিরে আসবে পরিবারে। সেই পরিবারে চলছে এখন কান্নার রোল।

শামীম বিল্লাহ্’র বাবা আমিনুর রহমান জানান, বুয়েটের দ্বিতীয় বর্ষের ১৭তম ব্যাচের নেভাল আর্কিটেকচার অ্যান্ড মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র ছিল শামীম। শেরে-বাংলা আবাসিক হলের ২০৪ নম্বর কক্ষে থাকত। ঘটনার সময় ভিডিওতে যে হেলমেট পরা ছিল ওই ছেলেটাই আমার ছেলে। কিস্তিতে একটি মোটরসাইকেল কিনে দিয়েছিলাম। ওইদিন কিস্তির টাকা জমা দিয়ে কেবলই হলে ঢুকেছিল। তখন বড় ভাইয়েরা ওকে ডেকে নিয়ে যায়। তারপর একবার সিগারেট ও একবার পানি আনতে বলে। শামীম সেগুলো নিয়ে আসে। শামীম বলেছিল, আমি আবরারকে মারিনি।

তিনি বলেন, ছেলেকে বহুবার বলেছিলাম আমরা গরিব মানুষ, কোনো রাজনীতির সঙ্গে না জড়াতে। তবুও ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। আবরারকে শামীম না মারলেও হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে গেল। ফাঁসির আদেশ হয়েছে। এখন কী করব। আমাদের পরিবারটি একেবারে ধ্বংস হয়ে গেল। কত স্বপ্ন ছিল ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হবে। যা রোজগার করেছি সব ছেলের পেছনে খরচ করেছি। এখন বাড়িতে শুধু কান্না আর আহাজারি।

ছেলের জন্য আপিল করবেন কীনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমি গরিব মানুষ। কশিমন ভিত্তিতে ট্রাক চালাই। এক হাজারে একশ টাকা হেলপারসহ কমিশন পাই। যে টাকা রোজগার করি তাতে সংসারও ঠিকমতো চলে না। টাকা পয়সা জোগাড় করতে পারলে ছেলেকে বাঁচানোর জন্য আপিল করব।

শামীমের লেখাপড়া কেমন ছিল প্রশ্নে বাবা আমিনুর রহমান জানান, লেখাপড়ায় খুব ভালো ছিল। অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি পেয়েছিল। শ্যামনগরে ২০১৫ সালে এসএসসিতে গোল্ডেন এ প্লাস পাওয়ার পর ঢাকাতে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। ২০১৭ সালে ঢাকার সেন্ট জোসেফস কলেজ থেকেও গোল্ডেন এ প্লাস পেয়ে উত্তীর্ণ হয়। এরপর বুয়েটে ভর্তি হয়। একটাই মাত্র ছেলে আমার। মেয়ে শারমিনকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছি। আর জীবনে কোনো চাওয়া পাওয়া নেই সব শেষ হয়ে গেছে। ছেলের জন্য কাঁদতে কাঁদতে এখন চোখের পানিও ফুরিয়ে গেছে আমার। বাড়িতে ওর মায়ের কান্না থামেনি আজও।

২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর বুয়েট ছাত্র আবরার হত্যাকাণ্ডের পর বাড়িতে পালিয়ে আসে শামীম বিল্লাহ্। এরপর ২০১৯ সালের ২১ অক্টোবর সাতক্ষীরার নিজ বাড়ির এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করে ঢাকায় নিয়ে যায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। বুধবার (৮ নভেম্বর) আবরার হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকায় ২০ আসামিকে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয় আদালত।

শামীম বিল্লাহ্’র দাদা আতিয়ার রহমান বলেন, শামীম জড়িত না। কিন্তু ঘটনায় নাম চলে এসেছে। পুলিশ ধরে নিয়ে যাবার পর থেকে দেখা হয়নি। ওর চাচা লাভলু ঢাকাতে ট্রাক চালায়। চাচার সঙ্গে মাঝে মধ্যে দেখা হয়েছে। এ রায়ের বিরুদ্ধে আমরা আপিল করব।

ভুরুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ফারুক হুসাইন জানান, শামীম নামের ছেলেটি শান্ত ভদ্র খুব মেধাবি ছিল। লেখাপড়ার কারণে এলাকায় তার বেশ সুনাম ছড়িয়েছিল। পরিবারটিও আওয়ামী লীগ মাইন্ডের। বুয়েটে ভর্তি হওয়ার পর ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। ঘটনাক্রমে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তার নামটিও এসেছে। মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়েছে শুনেছি। পারিবারটি এখন অসহায় হয়ে পড়েছে। শান্ত ছেলেটি কীভাবে এমন একটি ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ল সেটি আমরাও মানতে পারি না।

শ্যামনগর থানা পুলিশের অফিসার ইনচার্জ (ওসি) কাজী ওয়াহিদ মোর্শেদ বলেন, বুয়েটে সাধারণত মেধাবী শিক্ষার্থীরাই ভর্তির সুযোগ পায়। শামীমও মেধা তালিকায় সুযোগ পেয়েছিল। আমি যোগদানের পর থেকে তার ব্যাপারে কোনো অভিযোগ কখনো পাইনি।

সবারবাংলা/এসআই

Facebook Comments Box